বাংলাদেশে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রয়োজনীয়তা: একটি বাধ্যতামূলক নাগরিক দায়িত্ব
Ujjal Das ACA
10/7/2025


কেন আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক?
আয়কর রিটার্ন দাখিল—নামটি শুনলেই অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কিন্তু এটি কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং একজন সচেতন নাগরিকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক দায়িত্ব।
বাংলাদেশে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধ্যবাধকতা, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক। অর্থনীতি পরিচালনার জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও সেবার অর্থ সংগ্রহের অন্যতম মাধ্যম হলো এই আয়কর। যদি একজন নাগরিক সময়মত আয়কর রিটার্ন দাখিল না করে, তাহলে সরকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবে না। তাই এটি প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব, দেশের জন্য একটি সুস্থ অর্থনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, বাংলাদেশে কেন আয়কর রিটার্ন দাখিল করা এত জরুরি।
কেন আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক?
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। এই বাধ্যবাধকতা শুধু করযোগ্য আয় থাকলেই প্রযোজ্য নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে আয়ের সীমা নির্বিশেষে রিটার্ন দাখিল করতেই হয়।
১. আয়ের ভিত্তিতে বাধ্যবাধকতা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশনা অনুযায়ী, নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক:
সাধারণ ব্যক্তি করদাতা: যদি কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তির আয় বার্ষিক করমুক্ত আয়ের সীমা (বর্তমানে ₹৩,৫০,০০০ টাকা, যা প্রতি বছর পরিবর্তিত হতে পারে) অতিক্রম করে।
বিশেষ শ্রেণির করদাতা: নারী (৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব), তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা বা প্রতিবন্ধী স্বাভাবিক ব্যক্তির জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বেশি (যা প্রতি বছর পরিবর্তিত হয়)। তাদের আয় সেই বর্ধিত সীমা অতিক্রম করলে রিটার্ন দিতে হবে।
টিআইএন (TIN) ধারী: আইন অনুযায়ী, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) গ্রহণ করা বেশিরভাগ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। টিআইএন থাকলেই ধরে নেওয়া হয় আপনি কর ব্যবস্থার আওতাভুক্ত।
২. পেশা ও কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে বাধ্যবাধকতা
আয়ের পরিমাণ যাই হোক না কেন, বিশেষ কিছু পেশা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের জন্য রিটার্ন জমা দেওয়া আবশ্যিক। এনবিআর-এর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রায় ৪৫ ধরনের পেশা ও কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে টিআইএনধারীদের জন্য রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেমন:
সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল গণকর্মচারী।
কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার।
পেশাজীবী, যেমন: ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
কোনো ব্যবসা বা পেশা পরিচালনা করলে।
৩. সেবা গ্রহণের জন্য রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ বাধ্যতামূলক
বর্তমানে বহু সরকারি-বেসরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ বা প্রমাণপত্র (Acknowledgment Slip) দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো:
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ।
বাড়ি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন।
গাড়ি, লঞ্চ বা বিমান কেনা/রেজিস্ট্রেশন।
বিদেশ ভ্রমণে ভিসা আবেদন।
টেন্ডারে অংশগ্রহণ বা লাইসেন্স প্রাপ্তি।
অর্থাৎ, সঠিক সময়ে রিটার্ন দাখিল না করলে আপনি এসব গুরুত্বপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
রিটার্ন দাখিল না করলে কী হয়?
আয়কর রিটার্ন দাখিল না করা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং এর ফলে বেশ কিছু শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। যেমন, জরিমানা এবং উচ্চ হার আরোপসহ আইনগত জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। এটি কেবল সরকারের কাছে দায়িত্বশীলতার অভাব নয়, বরং এটি একটি নাগরিকের সামাজিক দায়িত্বকেও খর্ব করে। সুস্পষ্টভাবে, যারা রিটার্ন দাখিল করেন না, তাদের জন্য ভবিষ্যতে আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি, এ কারণে ব্যাংক ক্রেডিট ও অন্যান্য সুবিধার জন্যও সমস্যা দেখা দেবে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং এর ফলস্বরূপ করদাতাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়:
১. জরিমানা: আইন অনুযায়ী নির্ধারিত/বর্ধিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে (ধারা ২৬৬)।
২. অতিরিক্ত কর (Interest): বিলম্বিত রিটার্নের জন্য মাসিক ২% হারে অতিরিক্ত কর বা বিলম্ব সুদ পরিশোধ করতে হতে পারে (ধারা ১৭৪)।
৩. সুবিধা হারানোর ঝুঁকি: নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর রিটার্ন দাখিল করলে করদাতা বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত, কর অব্যাহতি বা করমুক্ত আয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
৪. করের হার পরিবর্তন: আপনার কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয়ও করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
কখন ও কীভাবে রিটার্ন জমা দেবেন?
বাংলাদেশে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যায়। তাই সময়মত রিটার্ন দাখিল করার জন্য নাগরিকদের যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করতে হবে এবং সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে। এছাড়াও, ডাকযোগে কিংবা অনলাইনে জমা দেওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
দাখিলের সময়সীমা: কোম্পানি ব্যতীত অন্যান্য সকল শ্রেণীর করদাতার জন্য প্রতি বছর ৩০ নভেম্বর হলো 'কর দিবস' বা রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন।
অনলাইনে দাখিল (E-Return): বর্তমানে (২০২৫-২৬ করবর্ষ থেকে) নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সকল স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি প্রক্রিয়াটিকে অনেক সহজ ও দ্রুত করেছে।
ফর্ম: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) ওয়েবসাইট বা নিকটস্থ কর অফিস থেকে রিটার্ন ফরম সংগ্রহ করা যায়।
আয়কর রিটার্ন দাখিল করা কেবল জরিমানা এড়ানোর জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার একটি সুযোগ। আপনার দেওয়া কর দেশের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জননিরাপত্তার উন্নয়নে সরাসরি সাহায্য করে।
শেষে বলা যায়, আয়কর রিটার্ন দাখিল বাংলাদেশের একটি আইনগত পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বও। এটি শুধু একটি ফরমের কাজ নয়; বরং, এটি দেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নসহ নাগরিকের সচেতনতার প্রতিফলন। তাই, প্রত্যেকটি নাগরিককে এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বোাঝার এবং যথাসময়ে রিটার্ন দাখিল করার গুরুত্ব উপলব্ধি করা উচিত।
অতএব, একজন সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সময়মতো এবং নির্ভুলভাবে আপনার আয়কর রিটার্ন দাখিল করুন। মনে রাখবেন, আয়কর রিটার্ন দাখিল এখন আর ঐচ্ছিক বিষয় নয়, এটি একটি বাধ্যতামূলক আইনি প্রয়োজনীয়তা!